বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের পুঁজি বাজারে অবহেলিত খাত গুলর মধ্যে অন্যতম হল মিচ্যুয়াল ফান্ড। এই খাত নিয়ে বিনিয়োগকারীদের এতটাই অনীহা যে, অধিকাংশ মিচ্যুয়াল ফান্ড তার মার্কেট এনেভি এর চাইতে বিশ/পচিশ শতাংশ ডিস্কাউন্টে লেনদেন হয়। নতুন ফান্ড বাজারে লিস্টেড হবার দুই-চার মাসের মধ্যে ফেস ভ্যালু দশ টাকা থেকে সাত-আট টাকায় নেমে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ক্লোজ এন্ড মিচ্যুয়াল ফান্ড লিস্টেড হবার সংখ্যা সাপ্রতিক বছর গুলতে কমে গেছে। একশ কোটি টাকার ফান্ড আইপিও থেকে পঞ্চাশ কোটি টাকা তুলতে হিমশিম খাচ্ছে। মিচ্যুয়াল ফান্ড নিয়ে ত্যাক্ত-বিরক্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এই খাতের নামই বদলে দিয়েছে – বিশ্ব ব্যাপি তুনলামূলক নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মিচ্যুয়াল ফান্ড বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের কাছে ‘মরণ ফাদ’ হিসেবে বদনাম কুড়াচ্ছে।
অথচ আমাদের বাজারে অনেক আশা-ভরসা, উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নিয়ে মিচ্যুয়াল ফান্ডের আগমন ঘটে ছিল। সরকারী এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি আইসিবির সাথে বেসরকারী এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির আবির্ভাবে মিচ্যুয়াল ফান্ড খাতে নতুন গতি যোগ করেছিল। বাজার সংশ্লিষ্ট সকলের প্রত্যাশা ছিল বহিঃবিশ্বে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় মিচ্যুয়াল ফান্ড বাংলাদেশের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। কিন্তু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও ফান্ড ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গুলোর যুগপত ভুলে মিচ্যুয়াল ফান্ড এখন মৃতপ্রায় খাতে পরিনত হয়েছে।
বেসরকারী এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গুলর হাত ধরে সব চেয়ে বেশী ক্লোজ এন্ড ফান্ড আসে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী হিসেবে ঐ সময়য়ে আমাদের প্রথম ভুল ছিল মিচ্যুয়াল ফান্ডের চরিত্র বুঝতে না পারা। বাজারের অধিকাংশ রিটেইল ইনভেস্টর তখন মিচ্যুয়াল ফান্ড ও কম্পানি স্টকের পার্থক্য বুঝতে পারেনি। সেকেন্ডারী মার্কেটে লেনদেনের শুরুতে কম্পানি স্টকের মতই মিচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিট চড়া দামে লেনদেন হয়েছে। ফলে দশ টাকা এসেট ভ্যালুর ইউনিট বিশ-ত্রিশ টাকায় কিনে নিজেদের ঝুঁকি বাড়িয়েছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীগন।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি অনেকটা উদার হস্তে ক্লোজ এন্ড মিচ্যুয়াল ফান্ডের অনুমোদন দেয়ায় ২০০৯-১০ সালের অতিমুল্যায়িত বাজারে যেমন অনেক মিচ্যুয়াল ফান্ড এসেছে, তেমনই ২০১১-১২ সালের মহা ধসের শুরুতেও বেশ কিছু মিচ্যুয়াল ফান্ড বাজারে আসে। ভুল সময়ে ফান্ড লঞ্চ করে এক দিকে বেসরকারী এসেট মেনেজমেন্ট কোম্পানিগুল বড় ঝুঁকি নিয়েছে। অপর দিকে মিচ্যুয়াল ফান্ডের টাকায় বাজারের পতন থামানো যামে এই ভরসায় মুরি-মুরকির মত মিচ্যুয়াল ফান্ডের আইপিও অনুমোদন দিয়েছে বিএসইসি। পতন থেকে উত্তরণের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই টেম্পোরারি স্যলুশন মিচ্যুয়াল ফান্ড খাতের জন্য পার্মানেন্ট ক্ষতির কারন হয়েছে পরবর্তী সময়য়ে। ফলে ২০১৫-১৬ সালে এসে অধিকাংশ ফান্ড ইউনিটের মার্কেট এনেভি তাদের কস্ট এনেভি থেকে দশ-বিশ-ত্রিশ ভাগ কমে যায়। শুরুতেই লোকসানে পড়ায় ফান্ডগুল বিনিয়োগকারিদের আশানরুপ লভ্যাংশ দিতে পারেনি। ফলে বাজারে হুহু করে দাম কমেছে।
পাশাপাশি কতিপয় এসেট মেনেজমেন্ট কোম্পানিগুলর পুজিবাজার বহির্ভুত অনৈতিক, অসচ্ছ বিনিয়োগ এবং মিচ্যুয়াল ফান্ডের বোনাস ইউনিট দেয়ার সুযোগ মিচ্যুয়াল ফান্ড খাতের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছে। সচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে অসাধু এসেট মেনেজমেন্ট কোম্পানির কেউ নিজেদের মালিকাধিন দুগদ্ধ-পলট্রি খামারে বিনিয়োগ করেছে। কেউ শত কোটি টাকায় ব্রকারেজ হাউজ কিনেছে। কেউবা ডুবতে বসা ফার্মাস ব্যাংকের দশ টাকা মূল্য মানের শেয়ার কিনেছে পাঁচ টাকা প্রিমিয়ামে।
তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এত খারাপ অবস্থার মধ্যেও ভাল ভাল কিছু মিচ্যুয়াল ফান্ড ও এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি আমাদের বাজারে এসেছে। যারা গত আট –দশ বছরে নিজেরদের কাজের মাধ্যমে তাদের কর্ম দক্ষতা ও বিশ্বাস যোগ্যতার প্রমান দিয়েছে। এই খাতের করুন অবস্থার মাঝেও কিছু ফান্ড ১৫-২০% গ্রোথ অর্জন করেছে। তাদের অনেকেই বছর বছর বিনিয়োগকারীদের ১০-১২% হারে ক্যাশ লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। এই বাজারে পাচ-সাত বছর ধরে গড়ে ২০% মুনফা করা ফান্ড মেনেজার আছেন। বিগত দশ বছরে ১৫ টাকা ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়ার পরেও দশ টাকা ফেস ভ্যালুর ফান্ডের কারেন্ট এসেট ভ্যালু ২০ টাকা হয়ে যাওয়ার মত মিচ্যুয়াল ফান্ড এই বাজারে আছে। বাজারে এমন ফান্ড আছে যাদের পোর্টফলিও তে ২০০ টাকায় বেটবিসি, ৫২ টাকায় স্কয়ার ফার্মা, ৭১ টাকায় জিপি, ২৪ টাকায় ব্যাক ব্যাংক, ২২ টাকায় ডরিন পাওয়ার অথবা ৬৮ টাকায় এমজেএল এর মত শেয়ার কেনা আছে। তাই বুদ্ধিমান ও সুযোগসন্ধানী বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ বাজার থেকে ১০০-৩০০ টাকা খরচ করে এই সব ভাল মানের শেয়ার না কিনে তুলনামূলক সস্তায় লেনদেন হওয়া ঐ সব ফান্ড ইউনিট কিনছেন ধীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ হিসেবে। ফান্ডের মেয়াদ শেষে এই সব স্মার্ট বিনিয়োগকারী বড় মুনফা গুনবেন তা প্রায় নিশ্চিত।
মিচুয়াল ফান্ড কি?
মিচ্যুয়াল ফান্ড আপনার-আমার মতই একটি বিনিয়োগকারী এনটিটি। আমি-আপনি ব্যাক্তি শ্রেণীর বিনিয়োগকারী আর মিচ্যুয়াল ফান্ড হল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। মিচ্যুয়াল ফান্ড ও আমাদের মূল পার্থক্য হল পূজির তারমম্যে। আমি আপনি যেমন শেয়ার বাজার ও ব্যাংক ব্যবস্থা তথা মানি মার্কেটে অর্থ বিনিয়োগ করি। ঠিক একই ভাবে মিচ্যুয়াল ফান্ড বিনিয়োগকারীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি একত্রিত করে বড় পুঁজি গঠন করে এবং ঐ পুঁজি শেয়ার বাজারে ও অর্থ বাজারে বিনিয়োগ করে। একটি কম্পানি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে উৎপাদন মূলক ব্যাবসায় নিয়জিত থাকে। ফলে তার মুনাফা সরাসরি উৎপাদ ও বিপনের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মিচ্যুয়াল ফান্ড যেহেতু সরাসরি উৎপাদন মুলক ব্যাবসায় নিয়জিত নয়; সেহেতু এর মুনাফা শেয়ার বাজার ও মানি মার্কেট থেকে প্রাপ্ত ডিভিডেন্ড, ক্যাপিটাল গেইন ও ইন্টারেস্টের ইনকাম এর উপর নির্ভর করে।আর একারনেই কোন কম্পানির শেয়ার মূল্য এর সম্পদ তথা এনএভি ও ইপিএস এর চেয়ে কয়েকগুন বেশি হতে পারে। কিন্তু মিচ্যুয়াল ফান্ডের দাম কোন ভাবেই তার এনএভির চাইতে কয়েকগুন বেশি হতে পারে না।
কেন মিচ্যুয়াল ফান্ড কিনবেন ?
ধরুন আপনি আপনার পোর্ট ফলিওটি সম্পুর্ন রুপে বিক্রি করে দিতে চান। এই অবস্থায় আপনার পোর্ট ফলিওর দাম নির্ধারিত হবে এতে থাকা শেয়ারগুলর চলতি বাজার-মূল্যে। আর আপনি যদি খুব ভাল এনালিস্ট হন যিনি সম্ভবনাময় ষ্টক আগাম বের করতে পারেন তবে হয়ত কেউ কেউ বাজার মূল্যের চেয়ে ১-৫% বেশি দাম দিয়ে কিনতে চাইতে পারে। কিন্তু কোন ভাবেই তার বেশি নয়। ঠিক একই ভাবে মিচ্যুয়াল ফান্ডের দাম ও হবে এর কারেন্ট মার্কেট এনএভি এর সমান বা সর্বোচ্চ ১০% কম-বেশি। কিন্তু কোন ভাবেই তার বেশি নয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য আমাদের বাজারে মার্কেট এনএভি চাইতে ২০ থেকে ৪০% ডিস্কাউন্টে অনেক ফান্ড ইউনিট লেনদেন হচ্ছে!
কিছু ফান্ডের ম্যানেজমেন্ট দূর্নীতিগ্রস্থ ও তাদের পোর্টফলিওতে সন্দেহ জনক বিনিয়োগ আছে সত্যি। সে কারনে বাজারে তাদের দাম কম। পাশাপাশি কিছু ফান্ড আছে যাদের পোর্টফলিও তুলনামূলক ট্রান্সপারেন্ট। ম্যানেজমেন্ট সততা ও দক্ষতার সাথে ফান্ড পরিচালনা করছেন। বছর বছর ১০% হারে লভাংশ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাজারে সঙ্গ দোষে (শুধু মিচ্যুয়াল ফান্ড হওয়ায়) এদের দাম মার্কেট এনএভি চাইতে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কম ! যারা কম ঝুঁকি নিয়ে যৌক্তিক পরিমাণ বাৎসরিক লাভে সন্তুষ্ট থাকেন তাদের জন্য ঐ সকল মিচ্যুয়াল ফান্ডগুল এখন বড় সুযোগ।
মিচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের আগে –
- ফান্ড ম্যানেজার ও এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি সম্পর্কে খোঁজ নিন। একই এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির অন্যান্য পুরোনো ফান্ড আপনাকে তাদের এফিশিয়েন্সি বুঝতে সহায়তা করবে।
- বাজারের টপ পার্ফমিং এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নির্বাচন করুন। মার্কেটের বেস্ট ১০-১৫ টি ফান্ডের মধ্য থেকে আপনারটি বাছাই করুন।
- ফান্ডের বিনিয়োগ ধরন (ইনকাম ফান্ড, বেলেন্স ফান্ড, গ্রোথ ফান্ড) ও তার ডিভিডেন্ড পলিসি কেমন তা জানুন।
- মিচ্যুয়াল ফান্ডের পোর্টফলিও তিন মাস পর পর প্রকাশ করা হয়। তাদের পোর্টফলিও দেখুন। পুঁজি বাজার ও মুদ্রা বাজার (প্রেফারেন্স শেয়ার,বন্ড, এফডিয়ার) ছাড়া অন্যাত্র বড় বিনিয়োগ থাকলে সতর্ক হোন। সন্দেহ জনক বিনিয়োগ থাকলে এড়িয়ে চলুন।
- মিচ্যুয়াল ফান্ডগুল এখন কোটা ভিত্তিক আইপিও পেয়ে থাকে। ফলে বড়-ছোট সব ফান্ড একই পরিমাণ প্রাথমিক শেয়ার পায়। তাই ছোট পেইড আপের ফান্ডগুল আইপিও থেকে তুলনামূলক বেশী মুনফা করে থাকে।
- অতীতের ডিভিডেন্ড পলিসি দেখুন। গত ৪-৫ বছরে নুন্যতম ৮-১০% ক্যশ ডিভিডেন্ড দেয়া মিচ্যুয়াল ফান্ডকে অগ্রাধীকার দিন।
- মার্কেট এনেভির চাইতে কম দামে লেনদেন হওয়া ফান্ড বোনাস ইউনিট দিলে তা এড়িয়ে চলুন।
- উপরের সকল শর্ত প্রতিপালন করার পরেও যদি কোন ফান্ড তার মার্কেট এনেভির তুনলায় ২০-৩০ ভাগ ডিসকাউন্টে পাওয়া যায়া তবে সেগুল বিবেচনা করুন।
- মিচ্যুয়াল ফান্ড ধীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ টুল।৫-১০ বছর ধরে রাখার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে মিচ্যুয়াল ফান্ড কিনুন। যারা পুঁজি বাজার সম্পর্কে কম ধারনা রাখেন অথবা পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না, মিচ্যুয়াল ফান্ড তাদের জন্য।
- সর্ট টার্ম ট্রেড করার জন্য মিচ্যুয়াল ফান্ড না কেনাই মঙ্গল। বছরের অধিকাংশ সময় এগুলতে ট্রেডিং অপুর্চ্যুনিটি পাওয়া যায় না।
- মিচ্যুয়াল ফান্ডের আয় পুঁজি বাজার পরিস্থিতি ও মানি মার্কেটের উপর নির্ভরশীল। পুঁজি বাজারের খারাপ সময়য়ে এবং ব্যাংক ইন্টারেস্ট রেট কমে গেলে মিচ্যুয়াল ফান্ডের আয় কমে যাবে।