পুঁজি বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রধান দুই চ্যালেঞ্জ হল – (এক) যাচাই-বাছাই করে এমন ষ্টক কেনা যা ভবিষ্যতে মুনফা দিবে। (দুই) কেনার পর লাভ সহ বিক্রি করতে পারা। বিনিয়োগের জন্য স্ক্রিপ্ট বাছাই করা যেমন গুরুত্বপূর্ন তেমনি গুরুত্বপূর্ন ও সম্ভবত অধিক কষ্ট সাদ্ধ কাজ হল সঠিক সময়ে বিক্রি করতে পারা। বিক্রির সিদ্ধান্ত ঠিকঠাক ভাবে নিতে না পারার কারণে প্রায় সময় লাভে থাকা ষ্টক থেকে মুনফা নেয়া সম্ভব হয় না, উল্ট ক্ষতির স্বীকার হতে হয়। আবার কেনার পর দাম কমা শুরু হলে যথা সময়য়ে ‘স্টপ লস’ না নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার আশায় দিন গুনে চল্লিশ-পঞ্চাশ শতাংশ লসে চলে যাওয়ার অভিগ্যতা ও আছে অনেক নতুন বিনিয়োগকারীর। তাই লস না দিয়ে লাভ তুলে আনা কিংবা অল্প লসে সেল দিয়ে বড় লসের হাত থেকে পুঁজি রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ন।
মুনফা করার প্রত্যাশা নিয়ে সবাই পুঁজি বাজারে আসে। কিন্তু বাস্তব সত্য হল এখানে টিকে থাকাই সকলের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। টিকে থেকে মুনাফা করা হল দ্বিতীয় লক্ষ্য। অধিক মুনফা করতে গিয়ে যদি প্রথম ট্রেডেই পুঁজি শূন্য হয়ে পরেন তবে সব সম্ভবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। এখানে পুঁজি রক্ষা করতে পারলে মুনফা করার জন্য দ্বিতীয়/তৃতীয় সুযোগ পাওয়া যাবে। বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেট নতুন বিনিয়োগকারীদের সফল হওয়ার দুইটি সূত্র দিয়েছেন –
- সূত্র এক – কখনো পুঁজি হাড়িও না।
- সূত্র দুই – সূত্র এক ভুলে যেও না।
পুঁজি রক্ষা করে মুনফা করার এই যুদ্ধে বিনিয়গকারীদের নিকট জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি হল –‘স্টপ লস’।মূলত অধিক লোকসানের কবল থেকে বাচার জন্যই কৌশলী বিনিয়গকারীগন এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বিনিয়োগের সময়কাল (ধীর্ঘ/সল্প মেয়াদী) ভেদে স্টপ লসের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হলেও ‘5% STOP LOSS’ অথবা ‘10% STOP LOSS’ বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয়।
‘10% STOP LOSS’ এই পদ্ধতিতে এক জন বিনিয়োগকারী কোন শেয়ারে সর্বোচ্চ ১০ ভাগ পর্যন্ত লোকসান মেনে নেন। লোকসান ১০% অতিক্রাম করলেই শেয়ারটি বিক্রি করে আরও অধিক লোকসান থেকে নিজেকে রক্ষা করেন। উদাহরণ স্বরূপঃ কম্পানি ক এর প্রতিটি শেয়ারে আপনার ক্রয় মূল্য ১০০ টাকা হলে,১০০ এর ১০% মানে ১০ টাকা পর্যন্ত আপনি ক্ষতি স্বীকার করতে চাইবেন। বাজার মূল্য যদি ৯০ টাকার নিচে নেমে যায় তবে আপনি শেয়ারটি থেকে বেড়িয়ে যাবেন।
রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এর একটি সাধারণ পদ্ধতি হল এই Stop Loss (SL)। উপায়টি আসলে মন্দের ভাল। কারন এর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এই পদ্ধতি আপনাকে শুধু অধিক মূল্য পতন থেকে বাচাবে কিন্তু কোন মুনাফার নিশ্চয়তা দেয় না। উপরের উদাহরণের শেয়ারটি ১০০ টাকায় কেনার পর দাম বেড়ে ১৫০ টাকা হল। দাম আরও বাড়ার প্রত্যাশায় আপনি শেয়াটি বিক্রি না করে ধরে রাখলেন। কিছু দিনের মধ্যেই দাম কমা শুরু হল। কমতে কমতে দাম ৯০ টাকার নিচে না আসা পর্যন্ত Stop Loss আপনাকে কোন Sell Signal দিবে না। সুতরাং ‘10% STOP LOSS’ পদ্ধতি ব্যবহার করায়, শুধু ১০ টাকা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে গিয়ে আপনি ৫০ টাকা মুনাফা করা থেকে বঞ্চিত হলেন।
Stop Loss (SL) এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার উন্নততর পদ্ধতি হল Trailing Stop Loss (TSL) । এই এডভান্সড পদ্ধতি স্টপ লসের মতই এক দিকে আপনাকে অধিক মূল্য পতন থেকে বাঁচাবে অপর দিকে মুনাফা রক্ষা করার নিশ্চয়তাও দিবে। যারা নতুন বিনিয়োগকারী তাদের অনেকেই বুঝতে পারেন না যে কত দামে তার হাতে থাকা শেয়ারটি বিক্রি করবেন। তাই অনেকে শেয়ার কেনার সময়ই একটি টার্গেট ঠিক করে অপেক্ষায় থাকেন। অভিষ্ট দাম পেলেই বিক্রি! ফলে শেয়ার হাত ছাড়া করার পর দাম আরও বেড়ে যাবার ঘটনা ঘটে উঠতি বাজারে। এমন অবস্থায় আফসোসে হাত কামড়ানো ছাড়া কোন উপায় থাকে না। নিরাপদ সীমার বাইরে থাকা দামে শেয়ারটি আবার কিনে আটকে যাবার সম্ভবনায় আপনি কেনার সাহস করতে পারেন না; অপর দিকে দাম ও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অর্থাৎ চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
এই অবস্থা থেকে বাচার একটি সফল উপায় হল ট্রেইলিং স্টপ লস অর্ডার। ধরুন ১০০ টাকায় কেনা ঐ শেয়ারে আপনার সেল টার্গেট ছিল ১২৫ টাকা। সে অনুযাই বিক্রির পড় দাম সর্বোচ্চ ১৫০ টাকায় উঠল। ফলে আপনি যদি আগেই নির্ধারিত মূল্য টার্গেট করে বিক্রি করেন তবে অতিরিক্ত ২৫ টাকা লাভ থেকে বন্চিত হবেন। ভাবুন যদি আপনি শেয়ারটি ১৩৫ বা ১৪২ টাকায় বিক্রি করতে পারতেন তা হলেও অতিরিক্ত কিছু পেতেন। একটি শেয়ারের সর্বোচ্চ মূল্য কত হতে পারে তা আমরা কেউই শত ভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারি না। তাই ঐ শেয়ারটি খুব কম ভাগ্যবান বিনিয়োগকারীই সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি করতে পারবেন। আর অধিক লাভের আশায় থাকা লোকজন আটকে যাবেন। তাই ১৩৫/১৪২ এ বিক্রি করতে পারলেই আপনার বিনিয়োগ সার্থক কারন আপনি Optimum Profit নিশ্চিত করতে পেরেছেন।
Trailing Stop – নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, এই পদ্ধতিতে শেয়ার মূল্য কে ট্রেইল বা অনুসরন করতে হবে। যা আমরা সবাই করি কিন্তু ঠিক উপায়ে করি না। অস্ভাবিক অবস্থা না হলে কোন শেয়ারের দাম টানা বাড়ে না। ৪/৫ দিন বাড়ে আবার ১/২ দিন কমে, আবার ৩/৪ দিন বাড়ে। অর্থাৎ উঠা-নামার মধ্যে উঠার গতি বেশি হলেই মূল্য বৃদ্ধি ঘটে।
এবার আমাদের উদাহরনটিতে ফিরে যাই, ১০০ টাকায় শেয়ারটি কিনে আমরা ‘10% Trailing Stop Loss ’ (10%TSL) ব্যবহার করা শুরু করব। এবার স্ক্রিপ্টের দাম উঠা-নামা নিয়ে দুঃচিন্তা না করে বাজার মূল্যকে শুধু পর্যবেক্ষণে রাখুনঃ
দিন-১ ক্রয় মূল্য ১০০, 10%TSL- ১০০*০.৯ = ৯০
দিন-২ বাজার মূল্য ১১০, 10%TSL- ১১০*০.৯ = ৯২
দিন-৩ বাজার মূল্য ১২০, 10%TSL- ১২০*০.৯ = ১০৮
দিন-৪ বাজার মূল্য ১১৫, 10%TSL- ১১৫*০.৯ = ১০৩ কিন্তু আমরা পূর্বের ১০৮ এই থাকব
[ব্যাখ্যাঃ কেনার চতুর্থ দিনে প্রথম বারের মত শেয়ারটির মূল্য ৫ টাকা কারেকশন হল। এই দিন আপনার 10%TSL হওয়ার কথা ছিল ১১৫*০.৯ = ১০৩ টাকা কিন্তু আগের দিনের 10%TSL ছিল ১০৮ যা ১০৩ এর চাইতে বড় তাই আজকের দিনের 10%TSL ১০৩ না হয়ে আগের ১০৮ ই থাকবে। মানে 10%TSL এর মান শুধু বাড়বে কক্ষনো কমবে না।]
দিন-৫ বাজার মূল্য ১২৫, 10%TSL- ১২৫*০.৯ = ১১২
দিন-৬ বাজার মূল্য ১৩০, 10%TSL- ১৩০*০.৯ = ১১৭
শেয়ারটি কেনার সময় আপনি মনে মনে টার্গেট করেছিলেন যে, ১২৫ এ বেচে দেবেন। আজ যেহেতু দাম ১২৫ অতিক্রম করেছে সেহেতু আপনি হয় 10%TSL এ স্থির থাকুন অথবা কিছুটা আক্রমনাত্নক হয়ে 8%TSL বা 5%TSL এ চলে আসুন।
দিন-৭ বাজার মূল্য ১৩৫ 10%TSL-১৩৫*০.৯=১২১, 8%TSL-১৩৫*০.৯২=১২৪, 5%TSL-১৩৫*০.৯৫=১২৮
দিন-৮ বাজার মূল্য ১৪৫, 10%TSL-১৩০, 8%TSL-১৩৩, 5%TSL-১৩৭
দিন-৯ বাজার মূল্য ১৫০, 10%TSL-১৩৫, 8%TSL-১৩৮, 5%TSL-১৪২
১০ম দিনে এসে শেয়ারটি কারেকশন মুডে চলে গেল
দিন-১০ বাজার মূল্য ১৪০, 10%TSL-১৩৫, 8%TSL-১৩৮, 5%TSL-১৪২ (বিক্রি)
দিন-১১ বাজার মূল্য ১৩৬, 10%TSL-১৩৫, 8%TSL-১৩৮ (বিক্রি)
দিন-১২ বাজার মূল্য ১৩৪, 10%TSL-১৩৫ (বিক্রি)
পদ্ধতিটি নিশ্চই বুঝতে পরেছেন, ১২৫
টার্গেট করে বিক্রি করার চাইতে ১৩৫, ১৩৮ বা ১৪২ এ বক্রি কারা অবশ্যই অনেক বেশি আকর্ষনী।
গুগল সার্চ করলেই এই টেকনিকের কিছু সুবিধা-অসুবিধা পেয়ে যাবেন। তখন ১০%, ৮% ও ৫% ট্রেইলিং
স্টপ লস সেট করার উদ্দেশ্য ও সময় কাল আরো ভাল বুঝবেন। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে ৮% ট্রেইলিং
স্টপ লস অনুসরণ করি।